পেপাল মাফিয়াদের গল্প

পেপাল মাফিয়া। দুটি শব্দই আমাদের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু ভিন্ন জগতের দুটি শব্দ একসাথে মিলল কিভাবে? সেই গল্প হবে আজ।

যারা অনলাইন ব্যবহার করি এবং অনলাইন ট্রানজেকশন করি বা জানি তাঁরা অবশ্যই পেপাল সম্পর্কে জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের দেশে এখনও পেপাল চালু হয়নি।

আর মাফিয়া শব্দটি শুনলে হয়তো কারো দাউদ ইব্রাহিমের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। আর মাফিয়া নিয়ে বেশি জল ঘোলা করলাম না, কারণ এটা আমাদের খুবই পরিচিত শব্দ।

পেপাল মাফিয়াদের গল্প
Corbis/The Telegraph

শব্দের খেলা তো অনেক হল, এবার আসল আলোচনায় ফেরা যাক।

পেপাল বর্তমান অনলাইন দুনিয়ার সব জনপ্রিয় ও স্মার্ট পেমেন্ট গেটওয়ে। এই পেপাল আজকের পেপাল হয়ে উঠার পেছনে যাঁদের অবদান ,তাদেরকে পেপাল মাফিয়া বলা হয়।

কিন্তু সেই বিখ্যাত কোন মাফিয়ার কাছে আজকে পেপাল নেই।

পেপালের শুরুর গল্প

পেপাল সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ম্যাক্স লেভচিন, পিটার থিল ও লুক নোসেক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত “কনফিনিটি” নামে যাত্রা শুরু করে। এরপর ২০০০ সালে কনফিনিটি এক্স.কম এর সাথে মিলিত হয় যেটি এলন মাস্ক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটা অনলাইন ব্যংকিং কোম্পানি।

পরে, ২০০১ সালে এটি পেপাল নামকরণ করা হয় এবং ২০০২ সালের ৩রা অক্টোবর $১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময় ইবে এটি কিনে নেয়।

পেপালের তৈরির পিছনের কারিগররা পরবর্তীতে টেসলা, ইউটিউব, লিংকডইন, স্লাইডের মত প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার বা কো-ফাউন্ডার। যারা এখন বিলিয়ন-মিলিয়ন ডলারের মালিক।

একটা কোম্পানী বিক্রির পর প্রত্যেকে তার নিজস্ব জায়গায় এভাবে সাফল্যের চূড়ায় উঠার কারণেই হয়তো তাদের মাফিয়া বলা হয়।

তাহলে আমরা সেই মাল্টি-ট্যালেন্টেড মাফিয়াদের সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করবো।

পেপাল মাফিয়াদের গল্প

যারা পেপাল মাফিয়া নামে পরিচিত, তাঁরা এখন সিলিকন ভ্যালিতে সবচেয়ে বড় ধনীগ্রুপ।

১. জাওয়েদ করিম

জাওয়েদ করিম বাংলাদেশী-জার্মান বংশোদ্ভূত আমেরিকান সফটওয়্যার প্রকোশলী। তিনি পেপালের রিয়েল-টাইম ইন্টারনেট জালিয়াতি বিরোধী সিস্টেম নিয়ে গবেষণা ও বাস্তবায়িত করেন।

তার আরও বড় পরিচয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিডিও শেয়ারিং ওয়েবসাইট ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা। পরে গুগল এটি $1.65 বিলিয়ন ডলারে ২০০৬ সালের নভেম্বরে কিনে নেয়।

জাওয়াদ করিম ইউটিউবে ‘মি অ্যাট দ্য জু’ প্রথমে ভিডিও ছাড়েন।

বর্তমানে জাওয়েদ করিম সম্পদের পরিমাণ প্রায় $140 মিলিয়ন ডলার।(সূত্রঃ ইন্টারনেট)

২.জেরেমি স্টপেলম্যান

জেরেমি স্টপেলম্যান পেপালে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান করেন যখন এটি এক্স.কম ছিল এবং পরে তিনি কোম্পানিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। ২০০৩ সালে ইবে পেপাল $১.৫ বিলিয়ন ডলারে কেনার কিছু পরে তিনি পেপাল ছেড়ে দেন। এরপর তিনি এবং তার বন্ধু রাসেল সিমন্স একটা অনলাইন রিভিউ সাইট Yelp এর পরিকল্পনা করেন।

এরপর পেপালের সাবেক প্রধান টেকনোলজি অফিসার  Max Levchin কে বুঝায় ওয়ান মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার জন্য। পরবর্তীকালে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হয়।

৩. অ্যান্ড্রু ম্যাককর্ম্যাক

অ্যান্ড্রু ম্যাককর্ম্যাক পেপালে ২০০১ সালে যোগদান করেন এবং কাজ করতেন পিটার থিয়েল (Peter Thiel) এর সহযোগী হিসেবে।

পেপাল ছাড়ার পর সান্স ফ্রান্সিস্কোতে একটি রেস্টুরেন্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন।

৪. প্রেমল শাহ

প্রেমল শাহ পেপালে ছয় বছর কাটান প্রডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে।

পেপাল ছাড়ার পর Kiva এর প্রেসিডেন্ট হন। কিভা মূলত একটা অলাভ জনক প্রতিষ্ঠান। এটি বিশ্বজুড়ে ৭০টিরও বেশি দেশে উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের অর্থ ধার দেয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে।

৫. লুক নোসেক

লুক নোসেক অন্যতম কো-ফাউন্ডার এবং মার্কেটিং এন্ড স্ট্রেটেজির ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

পেপাল ছেড়ে দেওয়ার পর লুক বিশ্বের নানা দেশ ভ্রমণ করেন এবং ২০০৫ সালে বন্ধু থিয়েল ও হাওরির সঙ্গে Founders Firm গঠন করেন।

৬. কেন হাওরি

কেন হাওরি পেপালের একজন কো-ফাউন্ডার এবং ১৯৯৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত প্রধান ফিনান্সিয়াল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পেপাল ইবের কিনে নেয়ার পর কিছুদিন ইবের ডিরেক্টর ছিলেন। ২০১২ সালে তিনি পপএক্সপার্ট নামে একটা অনলাইন লার্লিং প্লাটফর্ম দাড় করান যেটা ব্যবহারকারীদের বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ ঘটাতে সাহায্য করে।

৭. ডেভিড স্যাক্স

স্যাক্স পেপালের প্রধান অপারেটিং অফিসার ছিলেন।

পেপাল বিক্রির পর তিনি এসব ছেড়ে হলিউডে পাড়ি জমান এবং ২০০৫ গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন প্রাপ্ত ছবি Thank You for Smoking পরিচালনা ও অর্থ লগ্নি করেন। পরের বছর, তিনি বংশগতির ওয়েটসাইট Geni.com প্রতিষ্ঠা করেন।

২০১২ সালে Geni.com ইজরাইলি কোম্পানি MyHeritage এটি কিনে নেয়।

৮. পিটার থিয়েল

পিটাল থিয়েল অন্যতম পেপাল মাফিয়া। তিনি কোম্পানিটির কো-ফাউন্ডার ও সিইও ছিলেন।

পেপাল বিক্রির পর পিটার ৫৫ মিলিয়ন ডলার পান তার ভাগে এবং তা দিয়ে ক্লারিয়াম ক্যাপিটাল গঠন করেন যেটা কিনা ফেসবুকেও বিনিয়োগ করেছিল এবং এটা ছিল ফেসবুকের বাইরের কারোর প্রথম বিনিয়োগ।

পিটার থিয়েল এখন একজন বিলিনিয়ার। তার সম্পদের পরিমাণ ২.১ বিলিয়ন ডলার।

৯. কিথ রাবোইস

কিথ রাবোইস নভেম্বর,২০০০ থেকে নভেম্বর,২০০২ পর্যন্ত পেপালে এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, বিজনেস ডেভলপমেন্ট, পাবলিক অ্যাফেয়ার্স এবং পলিসি বিভাগে ছিলেন খুব খ্যাতি নিয়ে।

পেপাল ছাড়ার পর কিথ লিংকইড, স্লাইড, স্কয়ার এর মত প্রতিষ্ঠানে সিনিয়র পজিশনে ছিলেন। বর্তমানে কিথ ভেঞ্চার ক্যাপিটালের একজন পার্টনার এবং Yelp ও Xoom এর বোর্ড অব ডিরেক্টর।

তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।

১০. রিড হফম্যান

রিড হফম্যান প্রথমে বিশ্বের প্রথম স্যোসাল নেটওয়ার্ক স্যোসালনেট (যদিও ব্যর্থ) এ কাজ করতেন। সেখান থেকে পেপালে এসে চিফ অপারেটিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতেন। পেপাল বিক্রির সময় তিনি পেপালের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ডের দায়িত্বে ছিলেন।

পেপাল বিক্রির পর ২০০২ সালের ডিসেম্বরে লিংকডইন প্রতিষ্ঠিত করেন যেটি এখন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী স্যোসাল নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট। পরে এটি মাইক্রোসফট কিনে নেয়।

পেপাল মাফিয়াদের অন্যতম এই হোতার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার (ফোর্বস,২০১৯)।

১১. ম্যাক্স লেভচিন

ম্যাক্স কো-ফাইন্ডার ও প্রধান টেকনোলজি অফিসার ছিলেন। পেপালের এন্টি-ফ্রড সিস্টেম উন্নতিকরণে তার অবদান আছে।

পেপাল বিক্রির পর লেভচিন তার ভাগে ৩৪ মিলিয়ন ডলার পান এবং স্লাইড প্রতিষ্ঠিত করেন। পরে গুগল এটি কিনে নেয় এবং লেভচিন গুগলে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্ড হন। পরের বছর গুগল স্লাইড বন্ধ করে দেয় এবং লেভচিন চাকরি হারায়।

স্লাইডের উত্থানের পতনের মধ্যে Yelp প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন এই পেপাল মাফিয়া। বর্তমানে ইয়াহুর একজন বোর্ড অব ডিরেক্টর এবং সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার (২০১৪)।

১২. রোলফ বোথা

রোলফ পেপালের প্রধান ফিনান্সিয়াল অফিসার ছিলেন। তিনি তার গ্রাজুয়েট শেষ হওয়ার আগেই যোগ দিয়েছিলেন কর্পোরেট ডেভলোপমেন্টের পরিচালক হিসেবে।

বোথা এখন Sequoia Capital একজন পার্টনার এবং টাম্বলার, জুম (Xoom) এর মত কোম্পানীর ১৩টি কোম্পানীর বোর্ডে আছেন। গুগল ইউটিউব কেনার আগে তিনি ইউটিউবের বোর্ডে ছিলেন।

১৩. রাসেল সিমন্স

রাসেল পেপালের লিড সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট ছিলেন।

পেপাল ছাড়ার পর জেরেমি স্টপেলম্যান এর সাথে Yelp প্রতিষ্ঠিত করেন এবং প্রধান টেকনোলজি অফিসার হন। ২০১২ সালে সিমন্স Learnirvana প্রতিষ্ঠা করেন যেটা ব্যবহারকারীদের ভাষা শিখতে সাহায্য করে।

১৪. এলন মাস্ক

মাস্ক তার ইমেইল পেমেন্ট প্রতিষ্ঠান এক্স.কম কে পেপালের সাথে একীভূত করেন এবং পেপালের সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার হন।

পেপাল ইবের কাছে বিক্রি করে তার শেয়ারে তিনি ১৬৫ মিলিয়ন ডলার পান। ২০০২ সালের জুনে SpaceX প্রতিষ্ঠিত করেন। বর্তমানে SpaceX এর সিইও এবং সিটিও এবং প্রধান ডিজাইনার পদে আছেন। তিনি বিখ্যাত ইলেকট্রিক গাড়ি নির্মাণ কোম্পানী টেসলার সিইও।

এলন মাস্কের সম্পদের পরিমাণ প্রায় ১৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালের শুরুর দিকে এমাজনের জেফ বেসোস কে সরিয়ে বিশ্বের সেরা ধনী হয়েছিলেন।

আসলে বর্তমান টেক দুনিয়ায় অনেক নতুন কিছু এই পেপাল মাফিয়াদের হাত ধরে এসেছে।

সুত্রঃ বিজনেস ইনসাইডার, উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট।

আরও পড়ুনঃ ইতিহাসের সবচেয়ে ২০টি ভয়াবহ মহামারী

Leave a Reply