আল শাহারিয়া’র তিন

এক

আমি কেবলই নিথর চেয়ে থাকি‚ আদতে দেখি না কিছুই। আমাকে রেখে গিয়েছে এক কর্পোরেট শীত‚ গোছানো যৌবন আর অগোছালো কৈশোর। ফেলে গিয়েছে অক্সিজেন‚ বেপরোয়া লোকাল বাস‚ সিএনজির এক্সট্রা চার্জ আর…. মিরপুর!

ইতিহাস হবে না এসব‚ এক মামুলি দিনযাপন জানি। তবু‚ আমার কাছে ছিল হুট করে একটু হেসে ফেলা আর দূরপাল্লায় অনেকের থেকে দূরে থাকা। ছিল ঝকঝকে রোদ-বৃষ্টি দিনে সমবায় ছাতা‚ শ’খানেক নয়নতারার জীবন আর একটুকরো সবুজ। এসেছে কী এক জীবন‚ এ জীবন পার করে বাড়ন্ত ক্ষত ঠোঁটের আদরে শুকায়নি। এখনও ডানহাতি ব্যথা হুটহাট জাগে‚ তবু একমাত্র গন্তব্য মৌনতা!

আমার আক্ষেপ ছিল‚ যার মূল্য স্বস্তির কাছে নয় বড়ো কিছু। মানি। আমি কল্পনাপ্রিয়‚ যা কিছু পাই না চোখে‚ এঁকে ফেলি মনে। যেখানে চুল বাঁধে একটিমাত্র মেয়ে। সেও চলে গিয়েছে… না-কি তাকে নিয়ে গেল আমার ঝকঝকে অতীত?
প্রশ্ন রেখে গেলাম…

দুই

নবদীপ জ্বেলে দিলো কোন অতীতের অনামিকা,
জুড়ে দিলো কে প্রারম্ভে এই অনিকেত প্রহেলিকা?

বর্তমানকে ছুঁড়ে ফেলে আমরা সেই অতীতে ছুটে যাচ্ছি শেষ বিকেলের আলোয়। অতীতে নয়‚ আসলে আমরা ফিরছি ক্ষতিতে। বর্তমানকে দিচ্ছি রোজ প্রসিদ্ধ কাঙালপনা। যেখানে জীবনের অর্থ এসে অন্ধের মতো হাত বাড়িয়ে যায় মিলেমিশে‚ সেখানেই আমরা তুলে দিচ্ছি অযুত কালো জীবনের কার্নিশে।

প্রজাপতি প্রভাব ছাড়া নেই পৃথক সময়ের মধ্যে আহামরি যোগাযোগ কোনো। অতীতের প্রজাপতি প্রভাব গবেষণায় ফলাফল আবার ঋণাত্মক। মস্তিষ্ক বাঁচে জ্বালতে রঙিন আলো‚ বুঝেছে সে-ও এ যুগে আসলে দালাল-বৃত্তিই ভালো।

সময় বলছে আমাকে দ্যাখো‚ আমরা দেখছি অতীত। ভাবনা ভীষণ ভবিষ্যতের‚ সময়-যন্ত্রের গোপন আশকারা। ঠিকই ভাববে তুমি বিদায় বেলায়‚ সময় নিয়ে গেল কারা।

প্রশ্ন চাই না কোনো প্রহেলিকার ছাঁয়ায় বেড়ে ওঠা।

তিন

শোক — একটি উদযাপনের বিষয়বস্তু!

কতশত শোক সমাপতনে অগণিত হাসিমুখ অবাধ্য সূর্যের মতো দৃশ্যমান হয়। বেশ ক’বছর আগে ফেব্রুয়ারি’র একুশে শোকার্ত ফুলের বিনিময় অবলোকন করেছিলাম কৈশোর-প্রেমের নিমিত্তে। অবাক হয়েছিলাম সেবার। তারপর দিন গেল‚ মাস গেল। বছর ঘুরে এলো সভ্যতার বর্বরতম কালোরাত। শোকপ্রকাশ বলতে অর্ধনমিত একটুকরো বাংলাদেশ আর পাঠদান বন্ধই চোখে পড়লো। আমি শিখে এসেছি শোক অর্থ শিক্ষালয়ে পাঠদানহীন মজাদার সময়। একটুকরো অবসর এনে দেয় যেকোনো শোকদিবস। যত শোকার্ত নিরবতা পালন দেখেছি অধিকাংশ জায়গায় আমি হাসি-ঠাট্টার সাক্ষী হয়ে গিয়েছি।

গিলোটিনময় দিনগুলো ভুলে যেতেই পারে ফ্রান্স। আমরা কী করে ভুলি পঞ্চাশ পেরোতেই ত্রিশ লক্ষ শহীদকে! হ্যাঁ‚ অতীত আঁকড়ে সামনে এগোনোকে অনেকে সমর্থন করবেন না। বেশ তো‚ একদম বাদ দিন। শোককে উদযাপন আর উপভোগের প্রসঙ্গ বানিয়ে ফেলা তো ভীষণ অন্যায়। বাঙালী হিসাবে আমাদের নাম আমরাই রেখেছি গর্হিত কাজের সর্ববৃহৎ ধারক। আসলেই কি তাই?! সে যা হোক‚ এতকিছুতেও আমার খারাপ লাগেনি।

কিন্তু‚ সেদিন আমার শোকসভার সামনের সারিতে বসে কলহাস্যে একজন মেয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করছিলেন। ব্যথা পেয়েছিলাম। অবাক হইনি আর। বোধদয় হলো। আসলে‚ শোক একটি উদযাপনের বিষয়বস্তু।
হয়তো সোমেশ্বর অলি আমার আগেই নিজের শোকসভা ঘুরে বলে ফেলেছেন‚” নিজের শোকসভায় গিয়ে দেখি সবাই হাসছে।”

আল শাহারিয়া
কবি‚ গীতিকার ও কন্টেন্ট রাইটার

Leave a Reply