টাইম ব্যাংকঃ যেখানে সময় জমিয়ে রাখা যায়

টাইম ব্যাংক। একত্রে শুনতে নতুন হলেও আলাদা করে এ শব্দ দুটির সাথে আমরা পরিচিত।

টাইম বা সময় আমাদের এই পার্থিব জীবনে খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। সময় চলে গেলে সেটি আর পাওয়া যায় না। তার কাজ শুধু বয়ে সামনে দিকে এগিয়ে যাওয়া।

আর ব্যাংক, আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা ব্যাংক ছাড়া প্রায় অচল। মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং করে না, এই রকম তরুণ-তরুণী হয়তো কমই পাওয়া যাবে।

ব্যাংক আমাদের টাকা জমা রাখে এবং এই টাকার রক্ষণাবেক্ষণ করে। যখন আমাদের প্রয়োজন পড়ে তখন আমরা ব্যাংক থেকে টাকা সংগ্রহ করি। আবার, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে আমরা বাড়ি গাড়ি করি। অর্থাৎ, টাকা পয়সা সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার আমরা ব্যাংকের মাধ্যমে সমাধান করি।

আচ্ছা, টাকার মত যদি সময়কে জমা রাখা যেত, তবে কেমন হত?

আমরা সেই সময়কে পরবর্তীতে যখন ইচ্ছে ব্যবহার করতে পারবো। এই ধারণা থেকেই টাইম ব্যাংকের ধারণার উৎপত্তি। এই আইডিয়া কাজে লাগিয়ে সুইজারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে “টাইম ব্যাংক”।

কীভাবে কাজ করে এই টাইম ব্যাংক?

টাইম ব্যাংকের মূলত উদ্দেশ্য যারা বৃদ্ধ হয়ে গেছে তাদের সেবা করার একটা প্রক্রিয়া। আপনি যখন সুস্থ-সবল থাকবেন, তখন আপনি একটা নির্দিষ্ট সময় বৃদ্ধ মানুষের সেবা করবেন, আর সেই সময়টা আপনার টাইম ব্যাংকে যোগ হবে। আপনি যখন অক্ষম বা বৃদ্ধ হবেন, তখন ঐ সময়ের বিনিময় আপনাকেও অন্য কেউ সেবা দিবে। আপনার সেবা দেয়ার মাধ্যমে অন্য সেও তার টাইম ব্যাংকে সময় যোগ করল, যেটা সে পরবর্তীতে ব্যবহার করতে পারবে।

এভাবে সময় জমা ও খরচের মাধ্যমে বৃদ্ধদের সেবা চালু থাকবে, যেটা আসলে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে বৃদ্ধদের সেবায়।

টাইম ব্যাংকিং নিয়ে একটা গল্প

এক চাইনিজ তরুণ সুইজারল্যান্ডে পড়ালেখার জন্য গিয়েছিল। সে তার থাকার জন্য একটা বাসা ভাড়া করেছিল। তার বাড়িওয়ালীর নাম ছিল ক্রিশ্চিনা এবং বয়স ৬৭ বছর। যে বয়সে আমাদের দেশের লোকেদের বুড়ো-বুড়ি বলা হয়। ক্রিশ্চিনা তখন অবসরে। অবসরের আগে তিনি একটা স্কুলে পড়াতেন। সুইজারল্যান্ডে অবসর ভাতা বেশ ভাল, যেটা দ্বারা অর্থের আর চিন্তা করা লাগে না।

কিন্তু যখন ছেলেটা দেখল যে, তার বাড়িওয়ালী টাকার জন্য ৮৭ বছরের এক বয়স্ক মানুষকে সেবা করছেন, তখন সে খুব অবাক হল।

বিষয়টা বাড়িওয়ালীকে জিজ্ঞেস করাতে ভদ্র মহিলা এক অবাক করা উত্তর দিলেন, “ আমি আসলে টাকার জন্য এগুলো করছি না, আমি আমার টাইম ব্যাংকে সময় জমানোর জন্য একাজ করছি। আমি যখন বৃদ্ধ বা অক্ষম হয়ে যাবো তখন এই সময় আমি আবার উত্তোলন করতে পারবো”।

সেই চাইনিজ বালক টি যখন এই টাইম ব্যাংকের কথা শুনলো, সে খুবই অবাক হল এবং এ বিষয়ে তার বাড়িওয়ালীকে সবিস্তারে জানতে চাইলো।

টাইম ব্যাংক

এই টাইম ব্যাংক মূলত একটা অবসরকালীন প্রকল্প যেটা সুইচ ফেডারেল মিনিস্টারি অব স্যোসাল ইনসুরেন্স দ্বারা পরিচালিত।

ক্রিশ্চিনাকে দেখাশোনা ও সেবা শুশ্রূষা করা লাগতো লিসাকে, যিনি একা থাকতেন। তিনি লিসার কাছে সপ্তাহে দুইবার যেতেন এবং প্রতিবারে দুই ঘন্টা করে ব্যয় করতেন। এই সময় তিনি লিসার সাথে গল্প, তাকে হাটানো, ঘর পরিষ্কার ইত্যাদি করে সময় পার করতেন। চুক্তিনুসারে, ব্যাংক এক বছরের টাইম হিসেব করে তাকে একটা টাইম ব্যাংক কার্ড দিল। তখন তার সাহায্যের প্রয়োজন হবে, ব্যাংককে বললে তারা যাচাই-বাছাই করে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিবে।

আরও পড়ুন

একদিন সেই চাইনিজ ছেলেটি তার বাড়িওয়ালী থেকে ফোন পেল এবং জানতে পারলো যে তার বাড়িওয়ালী জানালা পরিষ্কার করার সময় পড়ে গিয়েছে। ছেলেটি খুব দ্রুত বাড়ি গেলে এবং ক্রিশ্চিনাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার পরীক্ষার পর জানা গেল, তিনি তার গোড়ালীতে আঘাত পেয়েছেন, এজন্য তাকে কিছু দিনের জন্যে বেডরেস্টে থাকতে হবে।

এজন্য ছেলেটি তার ছুটির জন্য আবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু করল, তখন তিনি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, এসবের প্রয়োজন নেই। সে অলরেডি টাইম ব্যাংক থেকে সময় উত্তোলনের জন্য আবেদন ফর্ম পূরণ করেছে।

দুই ঘন্টার ভিতর, টাইম ব্যাংক থেকে স্বেচ্ছাসেবক চলে এল ক্রিশ্চিনাকে সেবা দানের জন্য।

বর্তমানে টাইম ব্যাংকিং খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে সুইজারল্যান্ডে।  এটার কারণে সুইজারল্যান্ডের অবসরকালীন খরচ কমার পাশাপাশি নানা ধরনের সামাজিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে। সুইচরা তাদের বয়স্কদের প্রতি অনেক যত্নশীল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সুইচ তরুণ-তরুণিদের প্রায় অর্ধেক এ কাজের সাথে জড়িত। সুইজারল্যান্ডের সরকারও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে আইনের আওতায় এনেছে।

বর্তমান এ স্বার্থের পৃথিবীতে এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়। আমাদের দেশের যারা বয়স্ক আছেন, তারা অনেক সময় নিজ সন্তান দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন, এই রকম প্রকল্প থাকলে হয়তো তাদের সাহায্যের দুয়ার খুলতো।

এমন সেবাব্রত কার্যক্রম পৃথিবীকে করুন আরো সুন্দর ও মানবিক। টাইম ব্যাংকের এই উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক, ছোয়া লাগুক আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশেও।

Leave a Reply