বৈশাখের জানালা – আল শাহারিয়া

বৈশাখের জানালা তরুণ লেখক আল শাহারিয়া রচিত ছোটগল্প।

বৈশাখের জানালা

আল শাহারিয়া

বৈশাখের শেষের দিক। মস্ত বড় সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও অনেকদিন আসা হয়নি নিজ অঞ্চলে। নাড়ির বাঁধন প্রায় মলিন হওয়ার পথে। সেই ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় গিয়ে নতুন জীবন শুরু করার পর আর গ্রামে আসা হয়নি।এবার একটা আমন্ত্রণ পেয়ে বাবার আদেশেই নিজ অঞ্চলে আসা। এই অঞ্চলে নতুন একটি বিদ্যালয় উদ্ভোদন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়। ঝড়-ঝঞ্ঝার সময় তাই তড়িঘড়ি করেই শহরতলীর একটা উন্নতমানের পান্থশালায় এসে উঠলাম। যদিও আমাদের পুরাতন বাড়ি এখানে আছে। সেখানে এলাকার কোনো এক আত্মীয় বসবাস করে। ছোট চাচা সিলেটে থাকে। আমরা যাওয়ার পরপরই তারাও এই শহরতলীর জীবন শেষ করে সিলেটে বসবাস শুরু করে। মাঝেমধ্যে ছোট চাচা আসলেও তার পরিবারের অন্য কেউ এখানে আসেনা। আমি একটা চুরূট ধরিয়ে ঝুল-বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। আমার থাকার ব্যবস্থা দোতালায় করা হয়েছে। এখান থেকে পাশের গাছগুলো বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। পান্থশালার পাশে বাগান। বাগানটি পান্থশালার মালিকেরই সম্পত্তি। তবে এই বাগানের ভেতর প্রবেশ করায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় পান্থশালার ঘর নেওয়ার সময়ই। আজ তেমন বাতাসের জোর নেই। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে।মনেমনে ভাবছি পরে যদি কখনো আসি তাহলে নীলাকে সাথে নিয়ে আসবো। বৃষ্টির সময়ে আসবো।জানালার মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুয়ে দেখবো।নীলা খুব বৃষ্টি পছন্দ করে।এসব চিন্তা করার মাঝে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। পান্থশালার নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদক চালু হয়ে গেলো। শব্দ কানে না আসায় বুঝতে পারলাম না। চুরূট শেষ হতেই দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। আমি দরজা খুলে দেখলাম একটা মোটাসোটা লোক এসে হাজির। তার সাথে আরও দু’জন আছে।কথা বলে জানতে পারলাম তিনি এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান। পাঞ্জাবি-দাড়ি-টুপিতে খুব ধর্মভীরু মনে হলো। আমি দরজা খুলতেই লম্বা সালাম দিয়েছিলো। আমার খাওয়া-দাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে কি-না সেটাও জিজ্ঞেস করলো।তারপর আমাকে বলল,“স্যার,আপনি কাল সন্ধ্যায় তৈরি থাকবেন। এই দুইজন এসে আপনাকে নিয়ে যাবে।আমার বাড়ির লোকজন আপনাকে দেখতে চায়।”

“আরে আমাকে স্যার বলছেন কেনো?আমাকে তুমি করে বলেন।আমি অবশ্যই যাবো।”

“আমিও তুমি বলতে চেয়েছিলাম।কিন্তু সম্মানে তো তুমি অনেক বড় বাবা।”

আমি হাসলাম। তিনি কথা না বাড়িয়ে বিদায় নিলেন।খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম। খাওয়া শেষ করে নীলার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললাম। আমার এই কিছুক্ষণ ওকে ছাড়া থাকতেই মন উতলা হয়ে উঠেছে। কয়েকটা কথা বলেই ঘুমিয়ে গেলাম। কাল ভোরে আশপাশটা ভালো করে ঘুরে দেখবো। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কাল সকালটা কেমন হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেশ শীত শীত অনুভব হচ্ছিলো।নীলা সোয়েটার এগিয়ে দিলো। সে-ও বড়সড় একটা সোয়েটার পরেছে। কিন্তু আমি তো অবাক বনে যাই ওকে এখানে দেখে। আমার যতদূর মনে পড়ছে আমি একাই এসেছিলাম। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে নীলা বলল,“আমি যেতে পারবো না সাগর।কাল এতদূর জার্নি করে টায়ার্ড হয়ে গিয়েছি।তাছাড়া প্রচুর ঠান্ডা লাগছে।”

আল শাহারিয়া
লেখক

আমি তার ইংরেজি-বাংলার মিশ্রিত কথা শুনলেই মনে মনে রেগে যাই। কেনো জার্নি না বলে ভ্রমণ বলা যেত না? টায়ার্ড না বলে ক্লান্ত বলা যেত না? তাতে কি বাক্যের মৃত্যু হতো? আমি ইংরেজি ব্যবহার করি শুধুমাত্র সেই শব্দগুলোর যার অর্থ বাংলায় তেমন নেই।

আমি মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে পান্থশালা ত্যাগ করে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে পায়ে হেঁটে চললাম। রাস্তা চেনা মনে হচ্ছে খুব। যেন শৈশবের চিরচেনা মাটিতে পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার সামনে চেয়ারম্যান সাহেব আর তার সাগরেদ। তবে আজ পাঞ্জাবী পরে নি,মাথায় টুপি নেই। হয়ত সবসময় এসব বেশে বের হন না তিনি। আমাকে দেখে নমস্কার করলেন। আমি এবার আকাশ থেকে পড়লাম।সকাল থেকে যতই সবকিছু ঠিক আছে বোঝাতে চাচ্ছি ততই গরমিল হয়ে যাচ্ছে সবকিছুতে। তিনি আমাকে তার সঙ্গে তার বাড়িতে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমিও কি ভেবে যেন মত দিয়ে ফেললাম। তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম বাড়ির সীমানার ভিতর বিশাল মন্দির।মন্দিরে কয়েকজন মহিলা আর পুরোহিত বসে বসে শ্যামা সঙ্গীত গাইছে। কয়েকজন এলো পানি,সাবান নিয়ে। আমাকে হাত-মুখ ধুয়ে নিতে সাহায্য করলো তারা  তারপর আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে ঘরে প্রবেশ করলাম। কাল যার শরীরে আমি ইসলামি ছায়া দেখলাম সেই শরীরে আজ একজন প্রসিদ্ধ সনাতন মানুষকে কোনোভাবে মিলাতে পারছি না। ঘরের মধ্যে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের দেব-দেবীর ছবি সাজানো দেওয়ালে।আমি চারিপাশ দেখতে দেখতে সোফার কাছাকাছি যেতেই উনি আমাকে সোফায় বসতে বললেন। আমি সোফায় বসতেই দেখলাম পুজো শেষ করে একজন বয়ষ্ক মহিলা ও এক তরুণী ঘরে প্রবেশ করল। চেয়ারম্যান সাহেব পরিচয় করিয়ে দিলেন তাদের সাথে। মহিলাটি তার স্ত্রী এবং মেয়েটি তার একমাত্র সন্তান। খোলা চুল আর লাল-সাদা শাড়িতে দেবীর মতোই লাগছিলো মেয়েটাকে। চোখ দুটোর দিকে চেয়ে মনে হলো ভীষণ গভীর স্নিগ্ধতায় ভরা। আমার খাবারের আয়োজন করতে তারা মা-মেয়ে বাড়ির অন্দরে চলে গেলো। আমি আশপাশে চেয়ে দেখছি। অনেক মৃত জীবজন্তুর হাড়,হাড়ের অংশবিশেষে ঘরটি সাজানো। আমি দেওয়ালে আটকানো বাঘের চামড়ার দিকে এগিয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,“ এটা আমার বাবার শিকার করা বাঘের চামড়া। ”

আমি কথা বাড়াতে যেতেই উনি একটা বন্দুক বের করলেন বাক্স থেকে। অকেজো নষ্ট হয়ে যাওয়া বন্দুক। তিনি জানালেন তার বাবা এই বন্দুক দিয়েই পশু শিকার করতেন। তিনি বললেন,“ তিনি একবার কোনো প্রাণীর দিকে বন্দুক তাক করলে তাকে ভগবানের বাবাও বাঁচাতে পারতেন না।”

আমি দেওয়ালের শেয়ালের চামড়াটির দিকে অন্যমনস্ক হয়ে বললাম,“ভগবানের তো বাবা নেই।”

পরক্ষণে চেয়ে দেখলাম তার চোখে বিরক্তির ভাব। যেন আমার মতো এত বড় বেরসিকের পাল্লায় আগে কখনো পড়েনি সে। এটা যে কথার কথা সেটা আমার বোঝা উচিৎ ছিলো। 

খাবার আসলো। আমি টেবিলে বসলাম। পাশে চেয়ারম্যান সাহেব বসলো। মায়ের নির্দেশ অনুসরণ করে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করছে। রুই মাছের বড় মাথায় মুখে পুরে দিতেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার। দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। আমি দ্রুত স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলাম।অবশ্যই এটা একটা স্বপ্ন ছিলো। দুঃস্বপ্নও বলা চলে এটাকে। কি ভয়াবহভাবে সব পরিবর্তন হয়ে গেলো। আমি বিছানা ছেড়ে দরজা খুললাম। পান্থশালার একজন কর্মী এসেছে খাবার নিয়ে। বললাম‚“কি খাবার আছে?”

“স্যার গরুর মাংস আর গ্রাস কার্প মাছের ঝোল।”

আমার বিরক্ত লাগলো। কত সুন্দর আপ্যায়নের মাঝে বসে বিশাল পাকা রুইয়ের মাথা খাচ্ছিলাম।আর এই লোকটা এসে সব ভন্ডুল করে দিলো। আমি খাবার নিয়ে তাঁকে বিদায় দিলাম। হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। খেতে বসে বিরক্ত লাগলো।তবুও খেলাম অনেকটাই। তারপর আলোকচিত্র গ্রাহক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। স্বপ্নের মতো পরিচিত না লাগলেও কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছিলো চারিপাশ। স্বপ্নের মতো ঠিক একই জায়গায় গিয়ে দেখা হলো চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে। ভাগ্যিস টুপিটি মাথাতেই ছিলো।আমি সালাম দিলাম। উনি সালামের জবাব দিলেন মুখে প্রাপ্তির হাসি নিয়ে। আমি দু’একটা কথার মাঝেই চারিপাশের ছবি তুলতে লাগলাম। তিনি হঠাৎ বললেন,“স্যার,এই রোদে ঘুরবেন না।”

আমি ভীষণ একরোখা মনোভাবের মানুষ। নিষেধ করা স্বত্তেও দ্বিতীয়বার আমাকে স্যার বলল। আমি অবশ্য কিছু বললাম না। আবার নিষেধ করলাম। তিনি কাজের কথা বলে চলে গেলেন। আমিও হেঁটে হেঁটে চারিপাশ দেখতে লাগলাম। সামনেই একটা দোকান দেখতে পেলাম। দোকানের পাশে একটা ৫-৬ বছরের শিশু খড়ের উপর বসে আছে। অভুক্তই মনে হলো। আমি পাশে গিয়ে হাঁটু ভাঁজ করে বসে তার নাম জানতে চাইলাম। নাম জানতে চাইলাম। কিছুই বলল না। ধুলোমাখা শরীর আর লম্বা চুলে ওকে দেখে মায়া হলো। কয়েকজন আমাকে ঘিরে দাড়ালো। অনেকেই অনেক কথা বলল। জানলাম ছেলেটার মা-বাবা নেই। এখানে-ওখানে ঘুমায়। পাশের দোকানের নজু মিয়া খেতে দেয় মাঝেমধ্যে। কিন্তু বউয়ের কারণে থাকতে দিতে পারে না। ভাবলাম একা আছি এখানে। একটা সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। সবাইকে জানালাম আমি যতদিন এখানে থাকবো ততদিন ও আমার সাথে থাকবে। ওকে বললাম‚“চলো আমার সাথে। সকালে তো খাওয়া হয় নি।”

“কই যাবো ছার?”

“আমাকে ভাইয়া বলো। বাজারে গিয়ে নাস্তা করবো একসাথে।”

“আচ্ছা চলেন।”

ধুলোর মাঝ থেকে উঠে আসলো ছেলেটা। জামাটা দু-একবার ঝেড়ে নিলো। হেঁটে হেঁটে বাজারের দিকে যেতে লাগলাম।হঠাৎ ও বলল‚“তোমার নাম কি?”

বুঝলাম ভাব করতে চাইছে। আমি নাম বললাম না আমার। বললাম‚“তুমি তোমার নাম বলেছো কি?”

ও কি যেন ভাবল। তারপর বলল‚“আমার নাম আমি জানে না ছার। বাপ-মা কেডা তা-ও জানি নে।”

কি কারণে যেন স্যার বলায় রাগ করতে পারলাম না। আমি কথা বাড়ালাম না। কাপড়ের দোকানে গিয়ে ওর জন্য বেশ কয়েকটা কাপড় কিনলাম। তারপর আমরা বিরিয়ানি খেলাম। দুপুরের দিকে পান্থশালায় ফিরে দেখি নীলা বসে আছে। আমি না থাকায় ওকে বাইরেই বসতে হয়েছে। ওর কাছে গেলাম। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিলো। লোকলজ্জার ভয়ে সেটা আর হলো না। আমরা ঘরের দিকে যাওয়ার সময় নীলা অভি সম্পর্কে জানতে চাইলো। অভি হলো আমার সাথে থাকা ছেলেটি। আমিই ওর নাম দিয়েছি অভি। দরজা খুলে দিয়ে বললাম‚“ওর সম্পর্কে পরে সব বলবো। আগে মুখ-হাত ধুয়ে এসো তো।”

নীলা মুখ-হাত ধুয়ে কাপড় পাল্টে আসলো। আমি আর অভি বসে ছিলাম সোফায়। নীলা এসে বসলো। আমি বললাম‚“সকালে হাঁটতে বের হয়ে একে পেলাম। আমিও একা ছিলাম তাই ওকে নিয়ে আসলাম। কিন্তু এখন আর আমি একা নই। ওর নামটা আমি দিয়েছি। ওর বাবা-মা নেই।”

এসব বলার মাঝে অভির যেন কোনো মনযোগ নেই। সে খেলনা নিয়ে অন্য ঘরে চলে গেছে। অভি যেন আমাদের সন্তান আর আমরা ওকে নিয়ে আলোচনা করছি। নীলা বলল‚“বেশ তো ও থাকবে  আমাদের সাথে।”

আমি হাসলাম। এজন্যই নীলাকে আমার বেশি ভালো লাগে। ও আমার সব সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেয় খুব। ভুল করলে শুধরে দেয়। 

তারপর দুপুরের খাবারের ব্যপারে জানতে চাইলে নীলা বিরিয়ানি খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। আমরা আগেই বিরিয়ানি খেয়েছি সেটা বেমালুম চেপে গেলাম। বিরিয়ানি দিতে বলা হলো। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমি ঘুমালাম। আজ ঘুম বেশ ভালো হওয়ারই কথা। ৫ টার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। দেখলাম নীলা আর অভি গল্প করছে আর দুজনই হাসছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ওদের কাছে গিয়ে বসতেই নীলা আবার আমাকে উঠিয়ে দিলো। বলল‚“যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। এখন বের হতে হবে। চেয়ারম্যান সাহেব এসেছিলেন।”

আমরা তিনজন চেয়ারম্যান সাহেবের পাঠানো গাড়িতে চড়ে বসলাম। নীলাকে আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। নীল শাড়ি, নীল লিপস্টিক আর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়ে দিলাম হুট করেই। অভি আমাদের সাথে আছে সে কথা হুট করেই ভুলে গেলাম। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে বাড়িতে অনেক মানুষ দেখলাম। জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতে হয়ত সবসময়ই এমন উৎসব লেগেই থাকে। বাড়ির সদর দরজায় চেয়ারম্যান সাহেব ও বাড়ির কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। আমাদের সাদরে বাড়ির অন্দরে নিয়ে গেলো। নীলাকে দেখলাম সবাই আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী হিসাবে চিনেই ফেলেছে। খুশি হলাম। নীলা খুব ভালো করে জানে আমি মানুষের ভীড় পছন্দ করি না। তাই কায়দা করে দ্রুত পান্থশালায় পৌঁছানোর ইচ্ছা প্রকাশ করলো। চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে নিরিবিলি এলাকার কিছু কথাবার্তা জানার পর আমাদের খাবার দেওয়া হলো। আমি বেশি খেতে না পারলেও বেশ জোর করে খাওয়ালো বাড়ির লোকজন। মনে হচ্ছিলো জামাই আদরে ব্যস্ত সবাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে চেয়ারম্যান সাহেবের গাড়িতেই আমাদের পৌঁছে দেওয়া হলো আমাদের গন্তব্যে। পান্থশালায় যখন ফিরলাম তখন সাড়ে নয়টা বাজে। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। মনটা ভালো হয়ে গেলো। ঘরে প্রবেশ করে অভিকে একটা আলাদা কক্ষে ঘুমাতে বললাম। অভি ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর আমি আর নীলা সেই জঙ্গলের পাশের জানালায় আসলাম। 

আমি বললাম‚“এই আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে খুব।”

“উল্টাপাল্টা বায়না করলে শাস্তি দেবো কিন্তু। এখন বাবাকে ফোন দিয়ে যদি বলি আপনার ছেলে ভুলভাল আবদার করছে তাহলে কি হবে বুঝতে পারছো?”

আমি চুপসে গেলাম। ভয়ে নয় যুক্তিতে। এখন চা-কফির সময় না। আমার অন্যায় আবদার ছিলো এটা। আমি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম। বললাম‚“অভির মতো আমাদের একটা পিচ্চি হবে।”

“না। অভির মতো কেনো হবে? আমরা আমাদের বাচ্চার বাবা-মা হবো। কোনোদিন ওকে ছেড়ে যাবো না।”

আমি কিছু বললাম না। আসলে আমার কথার অর্থ ভিন্ন ছিলো। নীলার ঘুম প্রয়োজন বুঝলাম আমি। কয়েকঘন্টা ভ্রমণ করে তারপর এখানে এসে আরও কিছুক্ষণ বসে ছিলো। কিন্তু কোনো অভিযোগ করেনি বরং হাসিমুখে সবটা সামাল দিচ্ছে সেই দুপুর থেকে। আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে ওকে ঘুমাতে যেতে বললাম। বাধ্য মেয়ের মতো নীলা ঘুমাতে গেলো। আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। পাঁচ মিনিট পর দেখলাম আমার কক্ষে আসলো নীলা। হাতে দুটো মগ। আমি জানতে চাইলাম‚“কি আছে এতে”

“কেনো কফি!”

“এখন কফি বানাতে গেলে কেনো? সকালেই তো খেতে পারতাম। তুমি এতটা পথ ভ্রমণ করে এসেছো।”

“তাতে কি? তুমি তাড়াতাড়ি শেষ করো,আমি ঘুমাবো।”

যতদ্রুত সম্ভব কফি শেষ করলাম। নীলা চলে গেলো। আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। শেষরাতে ভীষণ বৃষ্টি হওয়ায় ঘুম ভেঙে গেলো। অনুভব করলাম গায়ে চাদর জড়ানো। বুঝলাম নীলারই কাজ এটা। মনে মনে বললাম‚“ স্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে নীলা কি মিছে মায়ের দায়িত্ব পালন করেছে?” চাদর টেনে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে নীলা ডেকে তুলল আমাকে। চোখ মেলে দেখলাম নীলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি দ্রুত উঠে বসলাম। জানতে চাইলাম কি হয়েছে। ও আমার হাত ধরে নিয়ে গেলো অভির কক্ষে। চাদর রক্তে ভিজে লাল হয়ে গিয়েছে। ঠিক পেটে একটা ছুরির আঘাত মনে হলো। কিন্তু ছুরিটা নেই। স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করলাম। পুলিশ লাশ নিয়ে গেলো। নীলা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলছে সকাল থেকে। পুলিশ পান্থশালা থেকে কাউকে বাইরে যেতে নিষেধ করেছে। বাবাকে জানাতেই সে রওয়ানা দিয়েছে এখানে আসার জন্য। অনেক খোঁজ করার পর হোঁটেলের পাশে রক্তমাখা ছুরিটা পেলো পুলিশ। পুলিশ অপরাধী শনাক্তকরণের জন্য আঙুলের ছাপ নেওয়া শুরু করলো। ভাগ্যের কি নির্মমতা নীলার সঙ্গেই মিলে গেলো ছাপ। আমি ভেতরে ভেতরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। নীলা ততক্ষণে স্তব্ধ। পুলিশ নীলাকে নিয়ে গেলো। আমি ওকে ছাড়তে পারছিলাম না কিছুতেই। আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করলাম না যে ও খুন করেছে। কেনো খুন করবে নীলা? নীলা তো ওকে চিনতোই না। আমি কোনো পথ খুঁজে পেলাম না অনেক ভেবেও। বাবা এসেছে মাত্র। তাঁকে সব খুলে বললাম। বাবা কোনো সমাধান দিতে না পরলেও তার উকিল বন্ধুকে যোগাড় করলো আদালতে লড়ার জন্য। কিন্তু আমি জানি নির্দোষ হতে প্রমাণ চাই। আমি ভাবলাম আমাকেই কিছু করতে হবে। সেদিনের মতো নির্ঘুম রাত কেঁটে গেলো আমাদের। রাত জেগে শুধু ভাবলাম নীলা কি করছে,কোথায় আছে। ভাবছি আজকের সন্ধ্যার বৃষ্টি আমাকে ডাকছে না,মেঘে ভরে গেছে আকাশ। ভীষণ শীতল চারিপাশ তবুও আমার চাদর দরকার হচ্ছে না। উদ্ভট চিন্তার বাসরে কেঁটে গেলো চির বিষাদের রাত। সকালে বাবাকে না ডেকেই নির্ঘুম দেহ নিয়ে হাজির হলাম থানায়। থানায় বড়বাবু তখনও আসেনি। আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। উনি এলেন। আমাকে চা দেওয়া হলো।খেলাম না। নীলার কথা জানতে চাইলাম। উনি বললেন‚“আপনার গেস্টকে ভালো ভাবেই রাখা হয়েছে।”

শুনে খুশি হলাম কতটা তা হয়তো বড়বাবু বুঝতে পারলেন না। আমি নীলার সাথে দেখা করতে চাইলাম। অনুমতি দেওয়া হলো আমাকে। নীলার কামরার সামনে গিয়ে দেখলাম বসে আছে ও। আমাকে দেখেই ছুটে এলো। কি করে যেন বুঝে গেলো আমি রাতে ঘুমাইনি। ওর মুখে একটু হাত রেখেই থানা থেকে বের হয়ে গেলাম। বলে এলাম আমাদের দেখা হবে সত্যের সূর্যের আলো ঝলমলে বিকেলে। বের হতেই দেখলাম বাবা আসছে থানার দিকে। আমি থামালাম বাবাকে। পান্থশালায় ফেরার পথে চারিপাশ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। বাবা বলতে বলতে হাঁটছে। হঠাৎ তার হাঁটা থেমে গেলো। আমি মাটির দিক থেকে মাথা তুলে দেখি চেয়ারম্যান ও বাবা একে অপরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব বাবাকে সালাম দিলো। বাবা কেমন যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে উত্তর দিলো সালামের। তারপর আমার হাত ধরে দ্রুত পা চালালো। বুঝলাম খুব গুরুতর কিছু হবে। কক্ষে প্রবেশ করেই আমার আগেই বাবা জানতে চাইলো চেয়ারম্যান সাহেবকে চিনি কি-না। আমি হেসে বললাম হ্যাঁ। কাল রাতে ওনার বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার গল্পটাও দিলাম ছোট করে। বাবা খুশি হলেন না। চেয়ারম্যান সাহেবের পরিবারের সাথে দূর অতীতের পারিবারিক শত্রুতার কথা শোনালেন তিনি। অথচ আমি কিছুই জানতাম না। সুন্দর হাসিমুখের আড়ালে কোনো শত্রুতা লুকিয়ে আছে এটা আমার বিশ্বাস হলো না। বাবা জানালেন এই চেয়ারম্যান সাহেবের জন্যই বাবা আর ছোট চাচা এই এলাকা ত্যাগ করেছিলো। পরেরদিন ছিলো বিদ্যালয় উদ্ভোদনের অনুষ্ঠান ছিলো। আমাদের দুপুরের খাবার আসলো। আমি খেলাম না। পান্থশালা থেকে বের হয়ে সোজা চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি গেলাম। বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ আসছে জোর চিৎকারের। ভিতরে প্রবেশ করতেই সবকিছু নিঃশব্দ হয়ে গেলো। চেয়ারম্যান সাহেব বাড়িতে নেই। তার ছোট ভাই আমার দিকে তাকিয়ে। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাতে ব্যান্ডেজ দেখলাম। এলাকার কোনো বিষয় ভেবে ওই প্রসঙ্গ ত্যাগ করলাম। চেয়ারম্যান সাহেবের ভাই আমাকে দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে কাল রাতে হারানো হারমোনিকার কথা জানতে চাইলাম। চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে দৌঁড়ে এসে আমাকে হারমোনিকাটা দিলো। সবার অনুরোধ সত্ত্বেও আমি আর বসলাম না। পান্থশালায় ফিরলাম। বাবা নেই কক্ষে। আমি হারমোনিকা বাজাতে লাগলাম। হঠাৎ ইচ্ছে হলো ওপাশের তালাবন্ধ ঘরটি খুলে দেখার। পুলিশ তালাবন্ধ করে রেখেছিলো। চাবি থাকায় প্রবেশ করলাম ভেতরে। জানালার কাছে ভাঙা কাচ দেখতে পেলাম। কাচে রক্ত লেগে আছে। আমি সাবধানে রক্তমাখা কাচের ছবি তুললাম। তারপর সাদা রুমালে ভাঙা কাচ মুড়ে রাখলাম। হঠাৎ বড়বাবু কল করলো। আমি ধরতেই জানালো ময়নাতদন্তের ফলাফল এসে গেছে। জানালো ছেলেটির মৃত্যু রাত ১০-১২ টার মধ্যে হয়েছে। আমি জানালাম তাহলে নীলা এই খুন করতেই পারে না। আমি কাচে রক্ত থাকার কথা জানালাম বড়বাবুকে। বড়বাবু রক্তটি চাইলেন। তিনি পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন বলেও নিশ্চিত করলেন। আমি থানায় গিয়ে বড়বাবুকে কাচ দেওয়ার ছলে নীলাকে আরেকবার দেখে এলাম।

আজ রাতেও ঘুম হলো না আমার। সারারাত নীলা আমার মস্তিষ্কে বিচরণ করলো। শেষরাতে ঘুমিয়ে গেলাম ক্লান্তিতে। বাবা সকালে ডেকে তুলল। মুখ-হাত ধুয়ে নিলাম। বাবার জোর করায় কিছু খাবার খেলাম। তারপর বিদ্যালয় উদ্ভোদন অনুষ্ঠানে গেলাম। চেয়ারম্যান সাহেব ছিলো সেখানে। আমাকে সান্ত্বনা দিলো সে। তার সাথে কথা বলার ফাঁকে সেই হাত কাটা লোকটিকে দেখতে পেলাম। সে চেয়ারম্যান সাহেবের সাথেই এসেছে। আমি জানতে চাইলাম হাত কাটার কারণ সম্পর্কে। মুখে স্পষ্ট মিথ্যার ভাব নিয়ে বলল ফল কাঁটতে গিয়ে কেঁটে গিয়েছে। আমি হাসলাম। অনুষ্ঠান শেষে দ্রুত পান্থশালায় ফিরলাম। আজ একটা বিশেষ জিনিস খেয়াল করলাম আমি। এখানে আসা থেকেই কয়েকজন আমার উপর নজর রাখছে। পান্থশালাতেও রয়েছে কয়েকজন। আমি দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে বারান্দায় এলাম। বারান্দা থেকে ওদের কয়েকজনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। ওরা কারো সাথে মুঠোফোনে কথা বলছিলো। আমি বুঝলাম এরা আমার উপর নজর রাখতেই নিয়োজিত। আমি সঙ্গে সঙ্গে বড়বাবুকে সবকিছু জানালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন তিনি। সেই লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেলেন। তাঁরা বেধড়ক মারধর করার পরে জানালো চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট ভাইয়ের কথায় এসব করছে। বড়বাবু দ্রুত চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট ভাইকে গ্রেফতার করলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি সব স্বীকার করলেন। খুনটা তিনিই করিয়েছেন। তিনি যে এখনও পারিবারিক শত্রুতা পুষে রেখেছেন তা কোনোভাবেই আমি মানতে পারছি না। রাতে আমাদের তিনজনকে দেখেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো অভিকে খুন করার। তাঁর মুলত উদ্দেশ্য ছিলো আমাকে ফাঁসানো। তিনি জানালেন পানপাত্র থেকেই তিনি কৌশলে হাতের ছাপ তুলেছে। কিন্তু আমার পানপাত্রে অন্য কেউ হাত দেওয়ায় তিনি নীলাকেই বিপদে ফেলতে চাইলো। রক্তের পরীক্ষা করে জানা গেলো ওই হাত কেঁটে যাওয়া লোকটিই খুনি। সে খুন করার পর খুব সাবধানতার সাথে হাতের ছাপ ছুরিতে লাগিয়ে দিয়েছিলো। তারপর পান্থশালার পাশেই ছুরিটা ফেলে দেয়। রাতে অন্ধকার থাকায় নীলা রক্ত দেখতে পারেনি। অভির গায়ে চাদরটা টেনে দিয়েই নীলা চলে এসেছিলো। সকালে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেই নীলা ওর ঘরে গিয়েছিলো। 

চেয়ারম্যান সাহেব পুরনো পারিবারিক শত্রুতা পুষে রাখেনি এটা জেনে খুশি হলাম। সে তাঁর ভাইকে যথাযথ শাস্তি দেওয়ার ব্যপারে সাহায্য করবেন জানালেন। এতক্ষণে নীলার স্পর্শ পেলাম। নীলাকে নিয়ে পান্থশালায় ফিরলাম। এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আমরা জানালায় গিয়ে দাড়ালাম। হিমেল বাতাস স্পর্শ করে গেলো আমাদের লোমকূপ। 

-বৈশাখের জানালা
আল শাহারিয়া

আরও পড়ুন

Leave a Reply