প্রেম মূলত যেমন

প্রেম মূলত যেমন আল শাহারিয়া এর লেখা একটি স্মৃতিচারণমূলক ছোট গল্প।

প্রেম মূলত যেমন

এ শহরে কবিতায় গল্প লেখা হয় আবার উল্টোটাও হয়। আকাশ-মেঘে বৃষ্টি এলে কিশোর-কিশোরীর নবযৌবনা প্রেম যেন আরেকটু উদ্দীপ্ত হয়ে ডানা মেলে আকাশে। তখন শহুরে রিক্সার প্রায় সত্তর শতাংশ তাঁদের দখলে থাকে। ওরা একগুচ্ছ কদমে আর চিনি ছাড়া বৃষ্টি মেশানো চা’য়ে চুমুক দিয়ে কী যেন এক অবিরাম উষ্ণতা খুঁজে পায়! আমাদের গল্পটাও এমনকিছু ছিলো। শোনো বলি।

এক শ্রাবণ বৃষ্টি শেষে ভাদ্রের শুরু। ইংরেজি মাস-বছর ঠোঁটের ডগায় রাখা ছেলেটি সবেমাত্র বাংলা মাস-বছরের খোঁজ রাখা শুরু করেছে। কারণ‚ মেয়েটি কবিতা প্রেমী। বাঙলা কবিতা। ভাবলাম‚ ও যেহেতু কবিতা ভালোবাসে সেহেতু আমাকেও কবিতাকেই ধারণ হবে। কবিতার সাগরে ডুব বা সাঁতার দেওয়ার মতো দুঃসাহস তখনও আমার হয়নি। প্রভাতের নতুন আলোয় ঘুম ভাঙা চোখে পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যা পাশে ফেলে রেখে আমি সাহিত্য পড়তাম। এভাবে দিন যেতে লাগলো। আমি ধীরে ধীরে অনুভূতি লিখতে শুরু করলাম। আমার তখন বাংলা সাহিত্যের প্রতি গভীর একটা টান তৈরি হয়ে গেলো। প্রেয়সীকে ভেবে ২-১০ লাইন অবলীলায় লিখে ফেলতাম। ওর কাছ থেকে বাহবাও পেতাম। কিন্তু‚ প্রেম বা ‘ও’কে ছাড়া আর কোনো বিষয়ে আমার লেখিনী নড়তো না। মস্তিষ্ক যেন প্রেয়সীর চিন্তায় মগ্ন! এই মহাপৃথিবীর অন্য কোনো বিষয়েই তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। এভাবে কয়েকবছর গেলো। আমি তখন ধীরে ধীরে প্রেমিক থেকে কবি হয়ে উঠতে লাগলাম। কবিতার মাঝে প্রেমিকার পাশাপাশি দেশ-দশ-সময়ের দেখা পেলাম। বুঝতে শুরু করলাম কবিতা মানে শুধুমাত্র প্রেমিকার কথা নয়। প্রেমিকা হলো কবিতার একটা অনুচ্ছেদ মাত্র।

একটু শহুরে হলাম। চারিপাশে নতুন পরিবেশ। নতুন শহর। নতুন আলো। সেই আলোয় এসে ঝলমলে চোখ দু’টো সবুজকে হারিয়ে ফেলল। অভিসার পেলেও প্রশান্তি যেন আমাকে আর ছুঁয়ে দেখলো না। আজীবন সবুজকে বুকে ধারণ করা মানুষের বেশি রঙিন দুনিয়া পছন্দ হয় না। প্রেমিকার চুলের বিদেশি শ্যাম্পুর ঘ্রাণ পেলেও পৌষের ধানের গন্ধ এ শহরে পাওয়া যায় না। এখানে ঘুমময় রাত বলে কিছু নেই। দিনের চেয়ে রাতেই বেশি মানুষের চোখ মেলে থাকা এ শহরের অভ্যাস। নানারকম রঙিন আলোর ভিড়ে অনন্য সুন্দর চাঁদের রুপালি আলো এ শহরে প্রবেশ করতে পারে না। অথচ শৈশবে এসবের সাথে আমার এক গভীর সম্পর্ক ছিলো। ন’টা বাজতেই বিছানায় মাথা পেতে রাখলে তালকাঠে গড়া জানালার ফাঁক দিয়ে জোৎস্না আমাকে ছুঁয়ে দিতো। জোৎস্নার সাথে লুকোচুরি খেলা হতো প্রতি পূর্ণিমায়। আবার কখনওবা বিশাল বিশাল গাছে ভরা নির্জন অরণ্য সাক্ষী হয়ে থাকতো পূর্ণিমা রাতের। বড়ো বড়ো গাছের ফাঁক দিয়ে জোৎস্না যেভাবে মাটিতে গড়িয়ে পড়তো সে দৃশ্য অপরূপ সুন্দর। আমার স্মৃতিকে প্রায়শই নাড়া দিতো এসব। সারাদিন কন্সার্ট‚ কনফারেন্স‚ ক্যাফেটেরিয়া‚ স্টেডিয়াম‚ পার্ক আর চায়ের কাপে অকৃত্রিমতা খুঁজে বেড়াতাম। যা কিছু অকৃত্রিম পেয়েছিলাম তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিলো বন্ধুদের ভালোবাসা। কিন্তু‚ আমার সবুজকে কোথাও আমি খুঁজে পায়নি।

আল শাহারিয়া
লেখক

একটা সময় নাগরিক কবি বনে গেলাম। শহরের গ্রাফিতি থেকে রিক্সার পেইন্টিং আমার কবিতায় স্থান পেয়ে গেলো। বুঝলাম প্রেমিকা আমার কবিতায় খুব সামান্য স্থান দখলে রেখেছে বা রাখতে পেরেছে। মানুষ আসলে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের জীবাত্মাকে কিছুটা হলেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরিবর্তন করে নেয়। কিন্তু‚ এ কাজ দ্রুত হয় না। আমিও বিভিন্ন রকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করতে শুরু করেছিলাম। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখা‚ জানা আর দেখার মধ্য দিয়ে আমার দিন যাচ্ছিলো। আমার প্রেমিকার বন্ধুমহল ছিলো আমার থেকে অনেক বড়ো এবং আধুনিক। ওদের কাছে শহুরে মানেই আধুনিকতা। আমার চিরপরিচিত কবিতাপ্রেমী মানুষটি কবিতাকেই ভুলে গিয়েছে দেখে কষ্ট যেন বুকের ভিতর মন্ত্রীর আসন ছেড়ে রাজার আসনে বসলো। তাঁর মুখে আর কখনও আমি অাবৃত্তি শুনিনি। ওদের আড্ডায় মাঝেমাঝে যেতাম। বাধ্য কবুতরের মতো চেয়ারে বসে থাকা আর দু-এক কাপ চা পান করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ ছিলো না সেখানে। আমার প্রেমিকা ও তাঁর বন্ধুদের উচ্ছ্বাস দেখলে আমার মনে পড়ে যেত ছোটোবেলার বৃষ্টিমুখর দিনে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলার কথা। একটামাত্র ফুটবল আর নড়বড়ে গোলপোস্ট নিয়ে মায়ের চোখ এড়িয়ে আমাদের খেলা চলতো। কাদামাখা মাটিতে একজন পা পিছলে পড়ে গেলে নিজের দলের খেলোয়াড়রাও হাসিতে গড়িয়ে পড়তো। সে-কি অকৃত্রিম উচ্ছ্বাস। ওখানে কেউ কাঁদতো না। কাঁদলেও বৃষ্টি কান্নাটা বুঝতে দিতো না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি আমার শৈশব অনিন্দ্য সুন্দর ছিলো।

আস্তে আস্তে প্রেমিকার সাথে দুরত্বের শুরু। প্রেম বলে কিছু আর তখন অনুভব হতো না। প্রেম মানে রোজ বিকেল পাঁচটায় দেখা করা‚ প্রেম মানে মুঠোফোনের বেহিসেবী আলাপন‚ প্রেম মানে একে অপরের খবর নেওয়া এসবের কিছুই ছিলো না। কেবল নামমাত্র একটি সম্পর্কের বন্ধন বা দেয়াল ছিলো। বুঝলাম এ বন্ধন ভেঙে দেওয়া আবশ্যক। প্রেম হলো আইন্সটাইনের Theory of Relatively এর মতো আপেক্ষিক। প্রেম মূলত দু’জনের পরষ্পর স্বার্থত্যাগ‚ বিশ্বাস এবং ভালোবাসার উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। এসবের কিছুই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সম্পর্কটা শূন্যে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। নিরবেই ভেঙে গেলো আমাদের প্রেম। হয়তো ভালোবাসাটা বাষ্পের মতো আগেই উড়ে গিয়েছিলো বলে সম্পর্কের বিচ্ছেদের শুরুতে কেউই আঘাত অনুভব করিনি।

দু’মাস পর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো মধ্যরাতে। টিকটিক ঘড়ির আওয়াজ আর কলোনির দূরের কোনো বাড়ি থেকে ভেসে আসা আধুনিক গান ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না। সেদিন ছিলো ভরা পূর্ণিমা। বুঝলাম সবুজ আমাকে ডাকছে। ততদিনে আমার একটা বাইক হয়েছে। এই রাত-বিরেতেই বেরিয়ে পড়লাম একটু নির্মল প্রশান্তি পেতে। শহরের সাথে সব লেনাদেনা চুকিয়ে আমি আবার সবুজে ফিরে যেতে চাইলাম। সবুজে এক অদ্ভুত সুন্দর শীতলতা আছে। অতঃপর পৌঁছে গেলাম শৈশবের রুপালি স্মৃতিতে ভরা সেই ঘন অরণ্যে। সেই রাত‚ সেই চাঁদ তবু কিসের যেন কমতি। আজ অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসে বুঝলাম‚ কবিদের নিরবেই ভালোবাসা উচিত।

— প্রেম মূলত যেমন
আল শাহারিয়া

আরও পড়ুন

Leave a Reply